Sach – The Reality

Northeast India's First Multilingual Foremost Media Network

Northeast India's First Multilingual Foremost Media Network

কখনও রং আসে ঔদ্ধত্যের কথা বলতে। কখনও রং আসে চরিত্রের নেতিবাচক দিকে আঙুল তুলতে। আবার দোলের দিন রং উৎসব নিয়ে আসে। একই শব্দের কত যে রূপ!

রং বদলায়।
রঙের মানেও বদলে যায়।
এ পর্যন্ত তো ছিলই।

কিন্তু রং কথাটি যেমন আনন্দের, তেমন আবেগের, আবার তেমনই বিদ্রুপ-তাচ্ছিল্যের অর্থ বহন করে প্রসঙ্গান্তরে। রং তো একই। শব্দটির রূপ তবু অনেক। ফাগুনে রঙের আগুন লাগার কথা যখন হয়, সে সব কত জনের মনে থাকে!

কখনও রং ব্যবহার করা হয় ঔদ্ধত্যের কথা বলতে। কখনও চালাকি বোঝায়। কখনও রং আসে চরিত্রের নেতিবাচক দিকে আঙুল তুলতে। আবার কোনও দিন সেই রং মতিভ্রমের কথা বলে। এক একটি রং যেমন এক এক ধরনের মেজাজ ধরে রাখে, তেমন মেজাজের রকমফেরের উপরে বদলায় ‘রং’ শব্দের মানে।

কখনও ‘পৃথিবী রঙিন হয়ে যাওয়া’-র কথা বলা হয় কোনও কিছু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাবের ইঙ্গিত দিতে। তারুণ্যের রং, প্রেমের রং এক প্রকার। কিন্তু ‘রংবাজি’, ‘রং দেখানো’, ‘রং নেওয়া’ হলেই গোলমাল। ঔদ্ধত্য থাকে তাতে। ‘রং দেখানো’ও তেমন। আবার তরুণ বয়সে চোখে ‘রঙিন চশমা পরা’-র মতো মন্তব্য আর এক রকম। কারও জীবন যদি ‘রঙিন’ বলা হয়, তা-ও তো আবার সহজ অর্থে নয়! তবু সবের উপরে রঙের খেলা। ‘বসন্তের রং’ হল সুখের, প্রেমের, আনন্দের ইঙ্গিতবাহক। ফলে উৎসবের দিনে রং শব্দের ইতিবাচক অর্থ প্রবল হয়। দোলের দিনে বেলা গড়ালে আবার রঙের বদলে যাওয়া মানে টেরও পাওয়া যায়।

রঙের যদি এতই রূপ হয়, তবে আনন্দের রং বা ভালবাসা-বন্ধুত্বের জন্য রং শব্দের ব্যবহার সবের উপরে রয়ে গেল কী করে? সে প্রশ্ন কিন্তু অনেকের মনেই ওঠে।

রং তো খেলা হয় বসন্তে। যখন চারপাশ রঙিন। প্রকৃতি ভরা নানা ধরনের রঙে। যা কিছু প্রাকৃতিক, তাতে সারল্য খোঁজে সমাজ। তা উদ্‌যাপন করতে চায়। করেও। কারণ, রং মনের উপরে প্রভাব তো ফেলে। দোলের দিনে লাল-হলুদ-গোলাপি আবির যেমন আনন্দের বার্তাবাহক। ভালবাসার প্রতীকও। মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ বলেন, ‘‘কিছু কিছু রং উদ্দীপনা জোগায়। আনন্দ দেয়। মনের উপর আনন্দের প্রভাব ফেলে। সে সব রংই উৎসবে ব্যবহার করা হয়। কোনও কোনও রং শান্তি দেয়, অথবা ভয় দেখায়। সে সব রং উৎসবের নয়ও!’’

আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে একই রং ভিন্ন ধরনের প্রভাব ফেলে মনে। যেমন কারও কাছে লাল হল প্রেমের রং। কারও জন্য তা-ই প্রতিবাদের রং। যদি মনে থাকে লাল, তার পর রং শব্দটি মনে পড়ে, তখন সেই কথাটির মানেও সে ভাবে বদলে যায়। মনোবিদ্যা বলে, কারও চোখ কোন পরিস্থিতিতে একটি রঙের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, তার উপরে নির্ভর করে সেই রং মনে কোন ভাব তৈরি করবে। রঙের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন শিল্পী কৌস্তভ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘আসলে তো কোনও রং নেই। সবই আলোর উপর নির্ভরশীল। যেখানে যে ভাবে আলো পড়ে, তার ভিত্তিতে একটি জিনিসের রং তৈরি হয়। কোথায় কে কোন রং দেখতে পাচ্ছি, তা কিন্তু স্থান, কাল, সংস্কৃতি ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। যেমন আমরা এখানে বসে সাদার দু’-তিন ধরন দেখতে পাই। আবার এস্কিমোরা অন্তত বারো ধরনের সাদা রঙের সঙ্গে পরিচিত। প্রতিটি সাদা রঙের আলাদা নাম আছে তাঁদের ভাষায়। বাংলা ভাষায় কিন্তু নেই।’’

রং শব্দের অর্থও কিন্তু সে ভাবেই বদলে বদলে যায় সংস্কৃতি-পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। কারও কাছে গেরুয়া রাজনীতির রং হয়। কারও কাছে সে রং শুধুই অপার ভক্তির। তেমনই সবুজ, তেমনই নীল, তেমনই সাদা। গেরুয়া-লাল কিংবা সবুজ রঙের আবির ছড়ানোর পরে তাই নিজ নিজ রাজনীতির উপরে নির্ভর করবে কার মনে ‘রংবাজি’-র উপলব্ধি হবে, আবার কার মনে তৈরি হবে নিতান্ত ‘রঙে মাতা’-র মতো ভাব। কলকাতার ‘গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ’-এর প্রাক্তন অধ্যক্ষা দীপালি ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমি কলেজে যাওয়া শুরু করতে না করতেই শুনেছি, রং শব্দের নানা ব্যবহার হয়। আমি শিল্পী, আমার কাছে রং মানেই ক্যানভাসে লাগানোর জিনিস। কিন্তু তা তো নয়। রং আমি দেখালে ক্যানভাস দেখাব, অন্য কেউ দেখালে আর এক রকম হবে। সে ভাবেই উপলব্ধি করতে শিখি রং কথাটি কেন আলাদা আলাদা প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়।’’ তবে তাতে ক্ষতি কী? রঙের যদি ব্যবহার নানা রকম হয়, তবে শব্দটির ব্যবহারও তা-ই হতে পারে। এমনই মত শিল্পীর। আরও বহু শব্দের যেমন হাজার মানে তৈরি হয়েছে পরিস্থিতিবিশেষে, ঠিক তেমনই।

মোহিত যেমন এখনও এক দোলের কথা মনে করে আতঙ্কিত হন। সে বার এক বিদেশিনির শ্লীলতাহানির ঘটনা জেনেছিলেন। তাঁকে কাঁদতে দেখেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘রং খেলার মানেও সে দিন থেকে বদলে গিয়েছে আমার কাছে। আর রং খেলায় শামিল হতে পারি না আমি।’’ দোলের দিনে বেলা গড়ালে পাড়ায় পাড়ায় যে সব চিত্র মাঝেমধ্যে দেখা যায়, তাতে যে শুধু রঙের মানে নয়, ‘রঙে মাতা’-র অর্থও আলাদা হয়ে যায়।

এককালে তো বোতল বা প্যাকেটবন্দি রং পাওয়াই যেত না। ১৯ শতকে যখন অন্তর্মুদ্রাবাদের প্রভাব পড়ে ইউরোপ থেকে শুরু করে গোটা দুনিয়ায়, তখন থেকেই মূলত প্যাকেটবন্দি তৈরি করা রঙের ব্যবহার বাড়ে। কৌস্তভ বলছিলেন, ‘‘তার আগে কিন্তু রং তৈরি করতেন শিল্পীরা। তখন ‘রং তৈরি’ কথাটিরও অন্য অর্থ ছিল।’’ সময়ের সঙ্গে সে ভাবেই তো বদলে যায় বহু শব্দের অর্থ।

রঙের অবশ্য মনের উপর অনেক রকম প্রভাব পড়ে। তার উপরেই নির্ধারিত হয়, রঙের মানে কখন কেমন হবে। তবে তা ব্যক্তিবিশেষে এক এক রকম হয়। অধিকাংশ বিশ্বাস-সংস্কৃতিতে কালো হল শোকের রং। কালো পরে সাধারণত বিয়ে হয় না। সাদা শান্তির রং। এ দিকে, শিল্পী সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মূলত সাদা আর কালো রঙে সাজেন। তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে কালো হল শান্তির রং। শান্তি পাই কালো রংটি দেখলে। সাদা আবার আমাকে শক্তি দেয়।’’ ফলে সাদা আর কালোকে যখন রং বলেই ভাবেন না অনেকে, তখন কারও কাছে আবার সেই রং অন্য রকম মানে বহন করে। তার সঙ্গে রঙের মানে আলাদা। মোহিতের বক্তব্যও তেমন, ‘‘রঙের যেমন রাজনীতি হয়, তেমনই হয় শব্দের।’’ রং হোক বা শব্দ, সবই চিহ্ন। ক্ষেত্রবিশেষে তার মানে আলাদা হয়।

দোলের দিনে রঙের মানে উৎসবমুখর। সেই ‘রং’ রোজের হলে যে আর উৎসব থাকে না। তাতে ‘রঙিন চশমা পরা’, ‘রং নেওয়া’-র প্রসঙ্গ ফিরে আসে। ঢোকে রাজনীতি। বদলে যায় মানে।

Wordpress Social Share Plugin powered by Ultimatelysocial